তারাবীর তিলাওয়াত থেকে ॥ ইউসুফ আলাইহিস সালামের কথা ॥ খাদ্য-নিরাপত্তা ও ব্যবস্থাপনা : সেকালে একালে মুফতি আবুল হাসান মুহাম্মাদ আব্দুল্লাহ

 তারাবীর তিলাওয়াত থেকে ॥ ইউসুফ আলাইহিস সালামের কথা ॥ খাদ্য-নিরাপত্তা ও ব্যবস্থাপনা : সেকালে একালে 



মুফতি আবুল হাসান মুহাম্মাদ আব্দুল্লাহ


অন্যান্য বারের মতো এবারও কয়েকজন তালিবুল ইলম হাফেজ সাহেব তারাবীতে তিলাওয়াত শুনিয়েছেন। বিভিন্ন কাজের চাপ থাকার কারণে অল্প কয়েকদিনে খতম শেষ করে শেষের দিকে মসজিদে তারাবীর জামাতে অংশগ্রহণ করা হয়। এবার খতমের শুরুর দিনেই এক হাফেজ সাহেব অনুরোধ জানালেনমাঝে মাঝে তিলাওয়াতকৃত আয়াত সম্পর্কে কিছু বলতে। চার রাকাতের বিরতিগুলোতে কখনো কখনো দু-একটি কথা বলা হয়েছে। কিন্তু প্রথম দিনেই বলে দিয়েছিকুরআনুল কারীম অতল সমুদ্রযাতে নিহিত বিস্ময়কর বিষয়ের সীমা-পরিসীমা নেই।

প্রতিদিন তিন পারা পড়া হয়েছে। কোনোদিন বেশি পড়া হয়েছে। কোনোদিন কিছু কম। সেখান থেকে অল্প দুয়েক আয়াত নিয়ে বলতে গেলেও অনেক সময়ের প্রয়োজন। প্রতিদিনের পঠিত আয়াতগুলোর অনেকটিতেই এমন অনেক বিষয় থাকেদিনের পর দিন যেগুলোর মাহাত্ম্যবর্তমান সময়ের সাথে সামঞ্জস্যমানবতার মুক্তির সাথে প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে আমাদের মতো নগণ্যজনেরও বলার সুযোগ আছে। যাঁরা আল্লাহর খাস বান্দাদক্ষ আলেমকুরআনে কারীমের পণ্ডিত দুনিয়া থেকে গত হয়েছেনআমাদের জন্য তাফসীর ও উলূমুল কুরআনের ভাণ্ডার রেখে গেছেন- তাঁদের কাছে তো তাফসীরের বিশাল খাযানা ছিল।

তবুও কোনো কোনো দিন দুয়েকটি কথা বলা হয়েছে। সেদিন পড়া হচ্ছিল সূরা ইউসূফ। তারাবীর মধ্য বিরতিতে এ নিয়ে দু-চারটি কথা হল। সূরা ইউসুফ কুরআনে করীমের এমন একটি সূরাযার বেশ কিছু স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য রয়েছে। অনেক বৈশিষ্ট্যের মধ্যে অন্যতম হচ্ছেএটি কুরআনে কারীমের একমাত্র সূরাযার মধ্যে একজন নবীর ঘটনা সবিস্তারে রয়েছে। আর কোনো নবী-রাসূলের ঘটনা এত বিস্তারিতভাবে ধারাবাহিক উল্লেখ হয়নি। এ দীর্ঘ সূরাটিতে রয়েছে অনেক ইবরত ও শিক্ষণীয় বিষয়। শেষের দিকে গিয়ে আল্লাহ তাআলা বলেছেন-

لَقَدْ كَانَ فِیْ قَصَصِهِمْ عِبْرَةٌ لِّاُولِی الْاَلْبَابِ.

নিশ্চয়ই তাদের ঘটনায় বোধসম্পন্ন ব্যক্তিদের জন্য শিক্ষা গ্রহণের উপাদান রয়েছে। -সূরা ইউসুফ (১২) : ১১১

মুফাসসিরীনে কেরাম তাফসীরের বড় বড় কিতাবে এসব বিষয় বিশদভাবে বলেছেন। হাফেয মাহমুদ যখন ধীর স্থীর গতিতে কিছুটা তারতীলের সাথে সূরা ইউসুফ তিলাওয়াত করেন তখন বিভিন্ন আয়াতেই বিভিন্ন কথা মনে পড়তে থাকে। বর্তমান সমাজের সাথে মিল-অমিল নামাযের মধ্যেই সামনে আসতে থাকে। একপর্যায়ে হাফেয সাহেব পড়লেন-

قَالَ اجْعَلْنِیْ عَلٰی خَزَآىِٕنِ الْاَرْضِ  اِنِّیْ حَفِیْظٌ عَلِیْمٌ.

ইউসুফ আ. বললেনআপনি আমাকে দেশের অর্থ-সম্পদের (ব্যবস্থাপনা)-কার্যে নিযুক্ত করুন। নিশ্চিত থাকুন আমি রক্ষণাবেক্ষণ বেশ ভালো পারি এবং আমি (এ কাজের) পূর্ণ জ্ঞান রাখি। -সূরা ইউসুফ (১২) : ৫৫

পাঠকবৃন্দের নিশ্চয় অনেকবার সূরা ইউসুফ পড়া থাকবে। তরজমা ও তাফসীর দেখা হয়ে থাকবে। ইউসুফ আ.-এর দীর্ঘ কাহিনী- বাবা-মা থেকে হারিয়ে যাওয়ামিশরে বিক্রি হয়ে যাওয়াএকপর্যায়ে জেলে যাওয়াজেল থেকে বেরিয়ে আসা ইত্যাদি। তিনি যখন নিরপরাধ প্রমাণিত হয়ে মুক্ত হয়ে আসলেন তখন সে সময়ের শাসক তাঁকে সসম্মানে তার কাছে রাখতে চাইলেন। বললেন-

اِنَّكَ الْیَوْمَ لَدَیْنَا مَكِیْنٌ اَمِیْنٌ.

আজ থেকে তুমি আমাদের কাছে অত্যন্ত মর্যাদাবান হলেতোমার প্রতি পরিপূর্ণ আস্থা রাখা হবে। -সূরা ইউসুফ (১২) : ৫৪

ইউসুফ আ. তাকে প্রস্তাব দিলেন সম্পদ-ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব প্রদান করতে।

এখানে দুটি শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে : একটি হচ্ছে حَفِیْظٌ অর্থাৎ আমি এটার যথাযথভাবে রক্ষকের দায়িত্ব পালন করব। তসরুফ হওয়া থেকে হেফাজতের দায়িত্ব পালন করব। দ্বিতীয় শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে عَلِیْمٌ অর্থাৎ এর যথাযথ জ্ঞান আল্লাহ তাআলা আমাকে দিয়েছেন।

সূরা ইউসুফ তো ছাত্রকালে পড়া হয়েছে। বছরকে বছর পড়া হচ্ছে। মাঝে মাঝেই হাফেয সাহেবদের থেকে শোনা হয়। আজ যখন আয়াতটি শুনছি তখন মনে হলএই যুগেই সূরাটি নাযিল হল কি না। কারণএর প্রেক্ষাপট সে সময়ের চেয়ে এখন আরো বেশি প্রাসঙ্গিক। আমরা যদি আজকের পৃথিবীর অর্থব্যবস্থা দেখিখাদ্যব্যবস্থা দেখিতাহলে এই আয়াত ও পরবর্তী আয়াতগুলোতে আলোচিত ইউসুফ আ.-এর রেশনিং ব্যবস্থা দেখতে পাব। আমাদের বর্তমান সময়ে যেগুলোর গুরুত্ব আরও বেশি প্রকাশ পায়।

ভেবেছিলামআজকের লেখার শিরোনাম দেবপ্রাচীনকালের একজন খাদ্য ও অর্থমন্ত্রীর কথা। কিন্তু পরবর্তীতে মনে হলমন্ত্রী শব্দ ব্যবহার ঠিক হবে না। যদিও বর্তমানে খাদ্য ও অর্থমন্ত্রীরা সেসব দায়িত্বেই নিয়োজিত থাকেন। আমরা যদি ইউসুফ আ.-এর ব্যাপারে মন্ত্রী শব্দ ব্যবহার করিতো এখনকার সময়ে দেশে দেশে থাকা অমুক তমুক মন্ত্রীরা ভাববেনবী ইউসুফ আ. মন্ত্রী ছিলেনআমরাও মন্ত্রী। অথবা কোনো পাঠক হয়তো হাল আমলের মন্ত্রীদের সাথে মিলাতে চাইবেন। বিষয়টি কিন্তু এমন নয়। আমরা যদি সূরা ইউসুফ বারবার পড়িএর মাহাত্ম্যগুলো খোঁজ করি এবং ইউসুফ আ.  খাদ্য ও অর্থবিভাগের দায়িত্ব পাওয়ার পর কী করলেন- সেগুলো খেয়াল করিবরং তারও আগে তিনি কী পরিকল্পনা পেশ করেছিলেনসেটি দেখিতাহলে আমরা বুঝতে পারবআমাদের মন্ত্রীরা আর ইউসুফ আ.-এর মাঝে কতই না পার্থক্য।

ببیں تفاوتِ رہ از کجاست تا بہ کجُا

দেখো দুটি পথের পার্থক্য কোথা থেকে কোথায় গিয়ে ঠেকেছে।

এখনকার ব্যবসা ও যোগাযোগব্যবস্থা উন্নত থেকে উন্নততর হয়েছে। এই পৃথিবীতে বসে যদি আমরা সেসময়ের অনুন্নত যোগাযোগব্যবস্থার সময় আল্লাহর নবী ইউসুফ আ. খাদ্য-ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব পাওয়ার আগে তিনি কী পরিকল্পনা রাষ্ট্রকে  দিয়েছেনপরবর্তীতে তিনি জেল থেকে মুক্ত হয়ে এ দায়িত্ব কীভাবে পালন করেছেনতাহলে বিস্ময়ের অন্ত থাকবে না। এর আগে বর্তমান সময়ের খাদ্য-ব্যবস্থার দিকে নজর দেওয়া যাক। খাদ্য সংকট অনেক দেশেই থাকে। স্বীকৃত বিভিন্ন সংস্থার হিসেব মতেই এখনো পৃথিবীর কোটি কোটি মানুষ না খেয়ে ঘুমাতে যায়। পৃথিবীতে সরকারগুলো খাদ্যে ভর্তুকি দেয়। খাদ্যশস্য উৎপাদনের সময়ই সরকার নির্ধারিত দামে নির্ধারিত পরিমাণে কিনে নেয়। পরবর্তীতে ভর্তুকি দিয়ে কম দামে বিক্রি করে। আমাদের দেশেও ওএমএস নামে খোলা বাজারে বিক্রি হয়। ট্রাক থেকে মানুষকে লাইন ধরে কিনতে দেখা যায়। আবার বিভিন্ন পেশার মানুষকে সরকার কম দামে রেশন দিয়ে থাকে। এরকম ব্যবস্থা বর্তমানে বিশ্বব্যাপীই আছে। সেই প্রাচীনকালে ইউসুফ আ.-ও খাদ্য-নিরাপত্তা ও খাদ্য-ব্যবস্থাপনার নজীর রেখে গেছেন। দুটোর পার্থক্য একটু দেখুনইউসুফ আ. জেলে থাকাকালে সেই সময়কার শাসকের একটি স্বপ্ন তার কাছে পেশ করা হল। কুরআনে যেটা বলা হয়েছে-

اِنِّیْۤ اَرٰی سَبْعَ بَقَرٰتٍ سِمَانٍ یَّاْكُلُهُنَّ سَبْعٌ عِجَافٌ وَّ سَبْعَ سُنْۢبُلٰتٍ خُضْرٍ وَّ  اُخَرَ یٰبِسٰتٍ یٰۤاَیُّهَا الْمَلَاُ اَفْتُوْنِیْ فِیْ رُءْیَایَ اِنْ كُنْتُمْ لِلرُّءْیَا تَعْبُرُوْنَ.

বাদশাহ (তার পারিষদবর্গকে) বললআমি (স্বপ্নে) দেখলামসাতটি মোটাতাজা গাভীযাদেরকে সাতটি রোগা-পটকা গাভী খেয়ে ফেলছে। আরও দেখলাম সাতটি সবুজ-সজীব শীষ এবং আরও সাতটি শুকনো। হে পারিষদবর্গ! তোমরা স্বপ্নের ব্যাখ্যা জানলে আমার এই স্বপ্নের ব্যাখ্যা বলে দাও। -সূরা ইউসুফ (১২) : ৪৩

বাদশাহর পর্ষদ ব্যাখ্যা না দিতে পারলেও ইউসুফ আ. জেলে বসেই এর ব্যাখ্যা প্রদান করলেন-

قَالَ تَزْرَعُوْنَ سَبْعَ سِنِیْنَ دَاَبًا ۚ فَمَا حَصَدْتُّمْ فَذَرُوْهُ فِیْ سُنْۢبُلِهٖۤ اِلَّا قَلِیْلًا مِّمَّا تَاْكُلُوْنَ ، ثُمَّ یَاْتِیْ مِنْۢ بَعْدِ ذٰلِكَ سَبْعٌ شِدَادٌ یَّاْكُلْنَ مَا قَدَّمْتُمْ لَهُنَّ اِلَّا قَلِیْلًا مِّمَّا تُحْصِنُوْنَ ، ثُمَّ یَاْتِیْ مِنْۢ بَعْدِ ذٰلِكَ عَامٌ فِیْهِ یُغَاثُ النَّاسُ وَ فِیْهِ یَعْصِرُوْنَ.      

ইউসুফ বললেনতোমরা একাধারে সাত বছর শস্য উৎপন্ন করবে। এ সময়ের ভেতর তোমরা যে শস্য সংগ্রহ করবে তা শীষসহ রেখে দিওঅবশ্য যে সামান্য পরিমাণ তোমাদের খাওয়ার কাজে লাগবে (তার কথা আলাদা)। এরপর তোমাদের সামনে আসবে এমন সাতটি বছরযা অত্যন্ত কঠিন হবে। তোমরা এই সাত বছরের জন্য যা সঞ্চয় করে রাখবেতা খেতে থাকবেঅবশ্য যে সামান্য পরিমাণ তোমরা সংরক্ষণ করবে (কেবল তা-ই অবশিষ্ট থাকবে)। তারপর আসবে এমন একটি বছর যখন মানুষের জন্য প্রচুর বৃষ্টিপাত হবে এবং তখন তারা আঙ্গুরের রস নিংড়াবে। -সূরা ইউসুফ (১২) : ৪৭-৪৯

তোমাদের দুর্ভিক্ষ আসবে। প্রথমে খুব ভালো ফসল হবে। এরপর দুর্ভিক্ষ হবে। সে সময়ের জন্য খাবার সংরক্ষণ করতে হবে।

এ তো গেল ইউসুফ আ.-এর ব্যাখ্যা। ইউসুফ আ. যখন অর্থ ও খাদ্য বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত হলেনতখন দুর্ভিক্ষের সময়যে দুর্ভিক্ষের কথা তিনি স্বপ্নের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে আগেই বলেছিলেন। তিনি দায়িত্ব নিয়েছিলেন কঠিন সময়ে। দায়িত্ব নেওয়ার পর তিনি শুধু তার দেশের লোকদেরকেই নাবরং দূরদূরান্তের অন্যান্য রাষ্ট্র থেকেও যখন মানুষ তার দেশে গিয়েছেতাদের সবাইকে দিয়েছেন। যারা অর্থ দিতে পেরেছেতাদেরকে দিয়েছেন। যারা অর্থ কম দিয়েছেতাদেরকেও দিয়েছেন। যারা দিতে পারেনিতাদেরকেও দিয়েছেন। কুরআনের আয়াত পড়লে আমরা দেখতে পাই-

فَلَمَّا دَخَلُوْا عَلَیْهِ قَالُوْا یٰۤاَیُّهَا الْعَزِیْزُ مَسَّنَا وَ اَهْلَنَا الضُّرُّ وَ جِئْنَا بِبِضَاعَةٍ مُّزْجٰىةٍ فَاَوْفِ لَنَا الْكَیْلَ وَ تَصَدَّقْ عَلَیْنَا  اِنَّ اللهَ یَجْزِی الْمُتَصَدِّقِیْنَ .

সুতরাং তারা যখন ইউসুফের কাছে পৌঁছলতখন তারা (ইউসুফকে) বললহে আযীয! আমরা ও আমাদের পরিবারবর্গ কঠিন মুসিবতে আক্রান্ত হয়েছি। আমরা সামান্য কিছু অর্থ নিয়ে এসেছি। আপনি আমাদেরকে পরিপূর্ণ রসদ দিয়ে দিন এবং আল্লাহর ওয়াস্তে আমাদেরকে দান করুন। নিশ্চয়ই আল্লাহ তাঁর উদ্দেশ্যে অনুগ্রহকারীদেরকে মহা পুরস্কার দিয়ে থাকেন। -সূরা ইউসুফ (১২) : ৮৮

এখানে দুটো বিষয় আছেআমরা অল্প করে টাকা নিয়ে এসেছিআমাদেরকে বেশি করে দিন। অর্থাৎ মূল্য কমখাদ্য বেশি। এটাও বলা হয়েছেআমাদের ফ্রি দিন। তাসাদ্দাক আলাইনা’ আমাদেরকে সদকা দিন।

ইউসুফ আ.-এর যুগে সেই প্রাচীনকালেযখন যোগাযোগব্যবস্থা উন্নত ছিল নাযখন এত আধুনিক প্রযুক্তি বের হয়নিসেসময়েও খাদ্য-ব্যবস্থাপনাখাদ্য-নিরাপত্তা এবং গণমানুষকেএমনকি নিজ দেশের বাইরের লোকদেরও স্বল্পমূল্যে ও বিনামূল্যে খাবার দেওয়ার নজীর আল্লাহর নবী ইউসুফ আ. রেখে গেছেন। আজকের পৃথিবীতে আমরা দেখিনিজেদের একটু অভাব হয়ে যাবেনিজ দেশে একটু কমে যাবেনিজের ব্যবসা কমে যাবে বলে বাধা দেওয়া হয়। পেঁয়াজ রপ্তানি নিষিদ্ধঅমুক বস্তু রপ্তানি হবে না- বিভিন্ন দেশ এগুলো করেনিজেরা কম পাবে- এ আশংকায় অন্যের বিপদ দেখলে ইচ্ছেমতো কয়েকগুণ মূল্য বাড়িয়ে দেয়া হয়।

میرے  حصے  کے  قطروں  پر   پہرہ بیٹھا رکھا ہے

اس نے اپنی  پیاس  کی  خاطر  دریا قبضہ رکھا ہے

আমার কয়েক ফোঁটা অংশের ওপর পাহারা বসিয়ে রেখেছে/ সে তার তৃষ্ণা নিবারণের জন্য দরিয়া দখল করে আছে।

নিজ দেশের ও অন্যান্য দেশের অভাবী লোকদের দুঃখ-কষ্ট লাঘবে নবী ইউসুফ আলাইহিস সালামের এ অভাবনীয় সফলতা এসেছিল তাঁর দুটি গুণের কারণে। ১. সততা ও নিষ্ঠা। ২. দক্ষতা ও কর্মকৌশল। কুরআনের ভাষায় হাফীজ ও আলীম। আজকের দুনিয়ায় ক্ষমতা আঁকড়ে থাকা মন্ত্রী-মহামন্ত্রীদের এ দুটি জিনিসেরই বড় অভাব। দায়িত্বে অধিষ্ঠিত থাকা ব্যক্তিদের ক্ষমতা চলে গেলেই অনেকের মহা কীর্তি(!)গুলোর যে ফিরিস্তি মানুষের সামনে আসেতা দেখেই বুঝা যায়তাদের সততার দৌড়...! তাদের সম্পদের পাহাড়ের তালিকাদেশ-বিদেশে গচ্ছিত অর্থের ভাণ্ডার ও অট্টালিকার তালিকা দেখেই মানুষ বুঝতে পারে তাদের সততার ভিত্তির কথা। এরা ব্যস্ত থাকে নিজের ও নিজের পরিবার-পরিজন এবং আত্মীয় স্বজনের ভাগ্যোন্নয়নের ধান্দায়। এই তো কদিন আগে নতুন মন্ত্রিত্বের তালিকা থেকে বাদ পড়া একজন সাবেক ভূমি প্রতিমন্ত্রীর বিলেতসহ অন্যান্য দেশে গড়া সম্পদের পাহাড়ের একটি তালিকা জনসম্মুখে এল। এ কথাগুলো যখন লিখছি তখন চলছে পুলিশের একজন সাবেক প্রধানের গড়ে তোলা বিশাল সম্পদভাণ্ডারের প্রচার-প্রচারণা। কোনো কোনো পত্রিকা শিরোনাম করেছে- ‘বেনজিরের আলাদিনের চেরাগ। এ ভদ্রলোক শুধু পুলিশ প্রধানের পদই অলংকৃত করেননিবরং এর আগে র‌্যাব ও ডিএমপির প্রধানও ছিলেন। ২০১৩ ঈ. সনের ৫ই মের শাপলা চত্বরে ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের নিধন-নির্যাতনেও তার ছিল অসাধারণ (!) ভূমিকা। হয়ত এই বৈশিষ্ট্যও তাকে সম্পদের পাহাড় বানাতে বিশেষ সহযোগিতা করে থাকবে। যা হোকহাল আমলের ক্ষমতাসীনগণ ও রাষ্ট্রের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের একটি বড় অংশ যেকুরআনে বলা সততা ও নিষ্ঠার অধিকারী নয়বরং তাদের অবস্থা যে পুরো উল্টো- তা তো মনে হয় ব্যাখ্যা করে বলার দরকার নেই। এদের কিছু কিছু ভেতরের অবস্থা প্রকাশ পায় ক্ষমতা-ছাড়া হওয়ার পর অথবা বড় ক্ষমতাওয়ালার বিরাগভাজন হওয়ার পর। আপনি কোন ডিপার্টমেন্টের কথা বলবেন। এই তো কবছর আগে কয়েকজন সিনিয়রকে ডিঙ্গিয়ে সর্বোচ্চ আদালতের প্রধান বিচারপতির দায়িত্ব পাওয়া সুরেন্দ্র কুমার সিনহা যখন পদ ছেড়ে দেশ থেকে পালালেনতখন তাকে নিয়োগ দেওয়া লোকেরাই প্রকাশ করল তার দুর্নীতির ফিরিস্তি। যাক সেসব কথা।

বাকি থাকল যোগ্যতা ও দক্ষতার কথাকুরআনের শব্দ হচ্ছে  عَلِيْمٌ (আলীম)। তো এখনকার খাদ্য ও অর্থমন্ত্রীদের যোগ্যতা ও দক্ষতার কথা কার অজানা। তারা নতুন নিয়োগ পাওয়ার পর কতই না হাঁকডাক দেন। সিন্ডিকেটের হাত-পা ভেঙে দেবেন। অবৈধ মজুতকারীদের এক বিন্দুও ছাড় দেবেন না। নিত্যপণ্যের দাম কোনোক্রমেই বাড়াতে  দেবেন না। তার মন্ত্রণালয়ে এক টাকার দুর্নীতি হবে না। এখানে-সেখানে গিয়ে দু-একটি অভিযানও করেন। এরপরএরপর কী হয়তারা কি সাধারণ মানুষের ভাগ্যোন্নয়নে ভূমিকা রাখেনতারা কি দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনপারেন কি মুষ্টিমেয় ব্যক্তিদের সিন্ডিকেট ভাঙতে। এদেশ এবং আমাদের মতো অনেক দেশেই এসব প্রশ্নের উত্তর নেতিবাচক। এসব দেশে খাদ্য ও অর্থের দায়িত্বশীলরা শুধুই জনগণকে হতাশা উপহার দিয়ে যান। কারণ খুব স্পষ্ট- সততা ও দক্ষতার অভাব। অযোগ্য ও দুর্নীতিগ্রস্ত লোকদের এসব গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে নিয়োগ দেওয়া হয়।

সূরা ইউসুফের আয়াতগুলো শুনছি। নবী ইউসুফ আলাইহিস সালামের সততা ও দক্ষতার অসাধারণ নমুনাগুলোর কথা পড়া হচ্ছে। অসাধারণ সক্ষমতার সাথে দুর্ভিক্ষ ও খাদ্য-ব্যবস্থাপনার কীর্তিগুলো আল্লাহর কালামে যখন আমরা শুনিতখন শুধুই মনে হয়আহ! পৃথিবীর দেশে দেশে যদি আবার দায়িত্বে আসত حَفِيْظٌ ও عَلِيْمٌ লোকেরা! আহ! যদি দুনিয়ায় আবার প্রতিষ্ঠিত হত সুষম খাদ্য ও অর্থব্যবস্থাযদি শোনা যেতএখন আর কোনো মানুষবরং কোনো প্রাণী না খেয়ে ঘুমোতে যায় না!

বিশ্ব যে আজ আধুনিক হওয়ার দাবি করছেউন্নত থেকে উন্নততর হওয়ার দাবি করছেসেবামানবাধিকারযোগাযোগে উন্নত হওয়ার দাবি করছে- আসলে কি তাইপ্রাচীনকালে আল্লাহর এক নবী যে দক্ষতার পরিচয় দিয়ে গেছেনযে মানবতার পরিচয় দিয়ে গেছেনতার ধারেকাছেও আমরা পৌঁছতে পারছি না। তবুও আমাদের দাবির কোনো শেষ নেই! 



Post a Comment

0 Comments